
ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম, জিম্মি রোগীরা
সাখাওয়াত শাকিল, ভোলা॥

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার জয়া এলাকার দিন মজুর মো. কবির হোসেন। তার মা বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় গত ৪-৫ দিন আগে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। গত বুধবার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেন। বার্ধক্যের কারনে তার মা বাস অথবা অন্য কোনো যানবাহনে উঠতে পারেন না। তাই বাড়িতে নেওয়ার জন্য হাসপাতালের সামনে থাকা চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। ওই অ্যাম্বুলেন্সটি সকালে চরফ্যাশন থেকে রোগী নিয়ে ভোলা ২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতালে এসেছেন। অ্যাম্বুলেন্সের চালক জসিম উদ্দিন ওই রোগীর স্বজনের কাছ থেকে ২৪০০টাকা ভাড়া চাইলে তারা দুই হাজার টাকা রাজি হয়। কিন্তু এরই মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় হাসপাতালের সামনে থাকা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা। তারা চালক জসিম উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে রোগী না নেওয়ার জন্য বললে তিনি তাদের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে তাদের কথায় রাজি হয়ে যান। এ বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের সামনে প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে রোগী ও তার স্বজনদের। পরবর্তীতে দুপুর ১টার দিকে একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ওই রোগী নিয়ে বোরহানউদ্দিন যায়।
রোগীর স্বজন কবির হোসেন জানান, তারা প্রথমে সরকারি একটি অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেটি ২৪০০টাকা চেয়েছে তারা দুই হাজার টাকায় যেতে রাজি হয়েছেন। পরবর্তীতে রোগী নিয়ে নিচে এসে জানতে পারেন সরকারি অ্যাম্বুলেন্স যাবে না। তাই প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের করে তার মাকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন।
চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. জসিম উদ্দিন জানান, তিনি প্রথমে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দুই হাজার টাকায় ভাড়া ঠিক করেছেন। পরে সেখানে থাকা বেরসরাকি অ্যাম্বুলেন্স চালকরা জানান, তারা একই ভাড়ায় বোরহানউদ্দিনে যাবেন এবং তাকে রোগী না নিতে বলেন। তাই তিনি আর কথা বাড়াননি। এছাড়াও এ সকল চালকরা সবাই তার পরিচিত ভাই-ব্রাদার।

ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সামনে রোগীর সঙ্গে এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও মালিকরা সিন্ডিকেট করে রোগীর স্বজনদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, রোগীর স্বজদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে এ সকল অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকদের বিরুদ্ধে। তাদের দৌরাত্মের কাছে হাসপাতালে আসা রোগীরা জিম্মি হয়ে আছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রোগী পরিবহনের জন্য ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের কম্পাউন্ডের মধ্যে ২০টির অধিক বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে হাসপাতালের সরকারি তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলোই রোগীর নিয়ে বিভিন্ন যায়গায় ছুটে যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোগীর স্বজনদেরকে জিম্মি করে তাদের অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে বাধ্য করছেন। এমনকি নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়াও। এছাড়া হাসপাতালের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্স ব্যতীত জেলার অন্য উপজেলা থেকে রোগী নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী নিতেও প্রতিনিয়ত বাঁধা প্রদান করেন এখানকার মালিক ও চালকরা।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন কামরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিন আগে তার এক আাত্মীয় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে তাকে ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। তার অবস্থা গুরুতর হওয়া তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল পাঠায় কর্তব্যরত চিকিৎসক। তিনি প্রথমে হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স খোঁজ করেন। কিন্তু হাসপাতালের সামনে থাকা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা তাকে জানায়, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও এখন চালক পাওয়া যাবে না। পরে তিনি বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে করে ১২০০টাকা দিয়ে ভোলার ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটে নিয়ে যান। অথচ সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে এখানকার ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকা। আর যখন কোনো লোক রোগী নিয়ে হাসপাতালে আসেন তখন অনেকেরই সাধারণ জ্ঞানও থাকে না। এই সুযোত কাজে লাগায় এই সিন্ডিকেট।
হাসপাতালের সামনে থাকা কয়েক জন রোগীর স্বজন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ভোলা সদর হাসপাতালে সরকারি তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সাধারণ রোগীদের ওই সকল অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সৌভাগ্য হয় না। কারন সাধারণ রোগীদের জিম্মি করে হাসপাতালের সামনে থাকা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা বেশী টাকা নিয়ে থাকেন। এমনকি বাইরের বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সকেও এখান থেকে রোগী নিতে দেন না এখানকার চালকরা। আর এ সকল অ্যম্বুলেন্সের নির্দিষ্ট কোনো ভাড়ার তালিকা নেই। তাদের ইচ্ছা মতো যা ভাড়া চাইবে তাই দিতে বাধ্য রোগীরা।
আরেক ভুক্তভোগী মো. আলমগীর অভিযোগ করে জানান, গত কিছু দিন আগে তার এক আত্মীয় ঘুরতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়। পরে তাকে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভোলা সদরের ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় রেফার্ড করেন। পরে ওই রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের সামনে থাকা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকদের সঙ্গে কথা বললে তারা সিন্ডিকেট করে সবাই ১৭ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে অন্য উপজেলার একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে কথা বললে তারা ১২ হাজার টাকায় যাওয়ার জন্য রাজি হন। কিন্তু ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসাপাতালের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্স চালকরা ওই অ্যাম্বুলেন্সকে রোগী নিতে দেননি। তাই তিনি বাধ্য হয়ে ১৭ হাজার টাকায় হাসপাতালের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন।
তিনি আরো জানান, ভোলা সদর হাসপাতালের সামনে থাকা সকল অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা একটি সিন্ডিকেট করে নিয়েছেন। ভাড়া এক যা চাইবে প্রত্যেকেই তাই চাইবে। কম দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ভোলা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি মো. মিলন হাওলাদার সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করে বলেন, অন্য উপজেলায় আমাদের অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে গেলে আসার সময় সেখানকার অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকরা সেখান থেকে রোগী আনতে দেন না। তাই আমরাও তাদেরকে সদর হাসপাতাল থেকে রোগী নিতে দেই না। তবে রোগী নিয়ে তারা এখানে আসতে পারেন। এছাড়াও অন্য উপজেলা থেকে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভোলা সদরে আসলে তাদেরকে আমারাই রোগী উঠিয়ে দেই। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রোগী নেওয়ার পর যে সকল রোগী থাকে সেই রোগী আমরা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স সিরিয়ান অনুযায়ী বহন করে থাকি।
ভোলা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ আবু সুফিয়ান রুস্তম কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের ভিতরে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের দৌরাত্ম কমানোর জন্য গেইট করতে চেয়েছি। এ বিষয়ে আমার ডিসি অফিস থেকে প্রশাসনিক সহায়তা চেয়েও পাইনি। এখন উল্টো তারা সিন্ডিকেট করে রোগীদের ওপর চাপ তৈরী করে। এমনকি চিকিৎসকদেরকেও মারধর করে। বিষয়টি এখন আর তাদের দেখার সুযোগ নেই। এখন এটি দেখবে প্রশাসন।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান কালের কণ্ঠকে জানান, অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কখনোই আমাদেরকে অবগত করেনি এবং লিখিত আবেদনও করেননি। তারা লিখিতভাবে আবেদন করলে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যববস্থা নেওয়া হবে।









